জেলার খবরদিনাজপুরদেশ

প্রধানমন্ত্রীর দিকে সবাই তাকিয়ে

যোদ্ধা ডেস্কঃ কমিউনিস্টরা অক্টোবরকে বিপ্লবের মাস মনে করেন। ১৯১৭ সালের ‘অক্টোবর বিপ্লবে’ রুশ সা¤্রাজ্যের পতন, বলশেভিকদের বিজয়ে দ্বিতীয় নিকোলাস ক্ষমতাচ্যুত হন। ওই সময় থেকেই অক্টোবর মাস এলেই কমিউনিস্টদের মধ্যে বিপ্লব-বিপ্লব ভাব শুরু হয়। বাংলাদেশের কমিউনিস্টদের কেউ ‘পঁচে গেছেন’ কেউ ‘দালালির খাতায়’ নাম লেখিয়েছেন। আর গণতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে ‘বিপ্লব’ শব্দটা বেমানান; তবে যুতসই শব্দ হলো নির্বাচন এবং জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা। অক্টোবরের আজ ২ তারিখ এবং সামনের কয়েকটি দিনকে অনিশ্চয়তা-আতঙ্কের মনে করছেন দেশের সাধারণ মানুষ। কারণ নভেম্বরের প্রথম দিকেই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করার কথা রয়েছে। নভেম্বরে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার ইংগিত দিয়ে গতকালও প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, আমাদের ওপর ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে বিতর্কের চাপ তৈরি হয়েছে। এখন জনগণের আস্থার সংকটই নির্বাচনের আসল সংকট। এখন থেকে তিন মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন করতে হবে; অথচ কোন পদ্ধতির সরকারের অধীনে ভোট হবে তা এখনো অনিশ্চিত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অনেকগুলো ইস্যু। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি, নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ না থাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত, প্রশাসনের আমলা-পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে সন্তানদের ভবিষ্যতে ভিসানীতিতে পড়ার আতঙ্ক, বেগম খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেয়ার দাবি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তলানিতে রিজার্ভ এবং ডলার সংকটের মধ্যে গার্মেন্টসের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তাসহ আরো কয়েকটি ইস্যু। এর মধ্যেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপিসহ অন্য দলের নেতারা আদিম যুগের ‘কলের গানের মতো’ একই সুরে নিজেদের বক্তব্য চালিয়ে যাচ্ছেন। সভা-সমাবেশ, টকশো এবং সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের নাম শুনেই শ্রতারা আগাম বলে দিতে পারেন ওই নেতা ‘কী কথাবার্তা’ বলবেন। বড় দুই দলের নেতাদের নিত্যদিন হারমোনিয়াম বাঁজানোর মতোই বক্তব্য সাধারণ মানুষ তো বটেই দলের নেতাকর্মীরাও গুরুত্ব দিচ্ছেন না; সবাই ত্যাক্ত-বিরক্ত। এমনকি দেশের সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবীরাও মনে করেন বড় দুই দলের এই নেতা, উপনেতা, পাতিনেতাদের কথাবার্তা কার্যত মূল্যহীন। সিদ্ধান্ত নেয়া বা গঠনমূলক কিছু করা এদের পক্ষ্যে সম্ভব নয়। তাই সবাই তাকিয়ে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর দিকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে দেশের বাইরে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘের অধিবেশনে অংশগ্রহণের জন্য যুক্তরাষ্ট্র যান। সেখান থেকে ওয়াশিংটনে কয়েকদিন অবস্থানের পর বর্তমানে লন্ডনে রয়েছেন। তিনি দেশে ফিরে এসে ভয়ঙ্কর অক্টোবর মাসে নির্বাচন ইস্যুতে কি বার্তা দেন সেটা শোনার জন্য সবাই মুখিয়ে রয়েছে। তবে দেশের সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার পুনপ্রতিষ্ঠার দাবির সঙ্গে সহমত রেখেই জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, জাপানসহ প্রভাবশালী দেশগুলো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। গতকাল মার্কিন অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি রেনা বিটার বৈঠক করেছেন ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব রিয়ার এডমিরাল খুরশিদ আলমের সঙ্গে। জাপানের রাষ্ট্রদূত ইয়োমা কিমিনোরি দেখা করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে। দুই বৈঠকেই নিরপেক্ষ নির্বাচন ইস্যুতে কথাবার্তা হয়েছে। ওবায়দুল কাদের জানান, সংবিধান অনুযায়ী সরকার দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। উল্লেখ ঢাকায় কর্মরত জাপানের সাবেক রাষ্ট্রদূত ২০২৮ সালের নির্বাচনকে কটাক্ষ করে বলেছিলেন, পৃথিবীর কোথাও শুনিনি রাতে ভোট হয়। গতকাল সবাই মুখিয়ে ছিলেন বেগম খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়া নিয়ে কি সিদ্ধান্ত হয় জানার জন্য। কিন্তু আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক সবাইকে হতাশ করে সেই পুরনো রেকর্ড বাজিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন বিদেশ যেতে হলে বেগম খালেদা জিয়াকে জেলে গিয়ে আবার আদালতে আবেদন করতে হবে। তিনি বলেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানো বিষয়ে ৪০১ ধারার ক্ষমতাবলে যে আবেদন নিষ্পত্তি করা হয়েছে সেটা খোলার আর কোনো সুযোগ নেই। আইনের ৪০১ ধারার কোনো দরখাস্ত যদি একবার নিষ্পত্তি করা হয়, সেই নিষ্পত্তি করা দরখাস্ত পুনর্বিবেচনা করার কোনো অবকাশ থাকে না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সাজাপ্রাপ্ত আসামি খালেদা জিয়াকে যেসব সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে তা মানবিকতার দৃষ্টান্তে পৃথিবীতে বিরল। আ স ম আব্দুর রবও একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামি ছিলেন। খালেদা জিয়ার প্রসঙ্গে আ স ম আব্দুর রব উদাহরণ হতে পারে না। হাজি সেলিমও কিন্তু আইনের বাইরে যাওয়ার সুযোগ পাননি। খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেছেন, ‘রাজনৈতিকভাবে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়েই বেগম খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেয়ার অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। চিকিৎসা নিতে কারাগারে গিয়ে তারপর আদালতে আবেদন করার কথা বলা ভয়ঙ্কর তামাশা। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় স্পষ্টভাবে বলা আছে সরকার চাইলেই নির্বাহী আদেশে তাকে মুক্তি দিতে পারে।’ এর আগে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিকও বলেছিলেন ‘সরকার নির্বাহী আদেশে বেগম জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে পারে; এ জন্য আদালতে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।’ ভিসানীতি নিয়ে সরকারের মন্ত্রী, এমপি, আমলা, পুলিশ বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মুখে যাই বলুক না কেন ভিতরে ভিতরে তারা মহাআতঙ্কে রয়েয়েছে। বিশেষ করে যেসব আমলার সন্তানরা বিদেশে পড়াশোনা করছেন তাদের মধ্যে উদ্বেগ বেশি। প্রশাসনের মধ্যে কিছুটা অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে পাতানো নির্বাচনের আয়োজন করার চেষ্টা হলে সরকার বেকায়দায় পড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাছাড়া এবার ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো ভারত আওয়ামী লীগ সরকারকে সহায়তা করছে না। গতকালও এক ওয়েবিনারে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সিঙ্গাপুরের ইনস্টিটিউট অফ সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের নন-রেসিডেন্ট সিনিয়র ফেলো ভারতের বুদ্ধিজীবী ড. শ্রীরাধা দত্ত বলেছেন, ‘বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে ভারতের কথা না বলাটাও একটা বার্তা। দিল্লিতে যে সরকারই থাকুক না কেন, তারা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে একইভাবে কাজ করে। প্রশাসনে কর্মরত আমলাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ-উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েছে। তবে আওয়ামী লীগ নেতা ও আমরাদের মধ্যে ‘উদ্বেগের কথা প্রকাশ করলে অন্যদের মনোবল ভেঙ্গে যাবে’ এই ধারণায় তারা প্রকাশ্যে ‘ভিসানীতি প্রভাব ফেলবে না’ এমন প্রচার করছেন। কিন্তু গতকাল বিদেশি পত্রিকায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন হাটে হাড়ি ভেঙ্গে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘সরকারি কর্মচারী এবং সমাজের উঁচুস্তরের মানুষের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির বিষয়ে ভয়-ভীতি থাকতে পারে। কারণ তাদের ছেলেমেয়ে বিদেশে থাকে। ওনারা অনেকে ঘুষ-টুষ খেয়ে দুর্নীতি করে বিদেশে বাড়ি-ঘর করেছেন। ওনাদের একটা ভয় থাকতে পারে যে ওনাদের যদি ভিসা না দেয় তাহলে বাড়ি-ঘরটা দেখভাল করবেন কীভাবে।’ গত কয়েক মাস থেকে বিএনপির যে কর্মসূচি দিচ্ছে তার পাল্টা কর্মসূচি দিচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বিএনপির পথযাত্রা, রোড মার্চ, অবস্থান কর্মসূচি ইত্যাদির বিপক্ষে আওয়ামী লীগ শান্তি সমাবেশ করছে। কয়েক মাস থেকে এই অবস্থা চলছে। বিএনপির ধারাবাহিক রোডমার্চ কর্মসূচি চলছে। গতকালও ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জ রোডমার্চ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। এরপর ৫ অক্টোবর চট্ট্রগামে রোডমার্চ কর্মসূচি পালনের পর নতুন ঢাকা কেন্দ্রীক ‘আল আউট’ কর্মসূচি দেবে। অন্যদিকে গতকাল আওয়ামী লীগ নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। ঢাকা মহানগরের সব সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত যৌথ সভায় এ কর্মসূচির ঘোষণা দেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ৩ অক্টোবর সাভারের আমিন বাজারে মহাসমাবেশ, ৭ অক্টোবর বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল উদ্বোধন, ১০ অক্টোবর পদ্মা সেতুর রেল সেতুর উদ্বোধন, ২৩ অক্টোবর মেট্রোরেলের মতিঝিল অংশ উদ্বোধন এবং ২৮ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু টানেলের উদ্বোধন উপলক্ষে আওয়ামী লীগ সুধী সমাবেশ। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিদর্শক না পাঠানোর ঘোষণায় যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, বাংলাদেশকে বিশ্বের মানুষ গণতান্ত্রিকই দেখতে চায়। নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক সংকুচিত হয়ে যাবে। বাংলাদেশ ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে বের হওয়ার পর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে।

এমন আরো সংবাদ

Back to top button