অর্থনীতিপ্রবাস

চুক্তি অনুযায়ী বেতন মেলে না প্রবাসী কর্মীদের

probasiভাগ্য ফেরানোর স্বপ্ন নিয়ে প্রতি বছর মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিচ্ছেন লাখ লাখ বাংলাদেশী কর্মী। বিদেশ যাত্রার আগে খরচ জোগাতে কেউ সম্পদ বিক্রি করছেন, কেউ নিচ্ছেন চড়া সুদে ঋণ। তবে বিদেশ পৌঁছেই স্বপ্ন ভঙ্গের মুখে পড়ছেন অনেকেই। বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসী কর্মীদের সমস্যা ও কষ্ট নিয়ে  ধারাবাহিক প্রতিবেদন দ্বিতীয় পর্ব

অভিবাসী কর্মী হিসেবে প্রায় তিন বছর ওমানে কাটিয়ে গত বছর জানুয়ারিতে ছুটিতে দেশে ফেরেন সিরাজগঞ্জের হামিদ আলী। ওমানে থাকাকালে একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন তিনি। তবে কভিড-১৯ সংকটে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে পুনরায় কাজে ফেরা হয়নি তার। আগে যে এজেন্সির মাধ্যমে ওমান গিয়েছিলেন, সেই প্রতিষ্ঠানটি বলছে, অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে চুক্তিপত্র সংগ্রহ করে ওমান যেতে পারবেন তিনি। সেটি না পাওয়া গেলে সৌদি আরবে পাঠানোর প্রস্তাবও দেয়া হয়েছে হামিদ আলীকে। তবে এ মুহূর্তে সৌদি আরব, ওমান বা মধ্যপ্রাচ্যের অন্য কোনো দেশে যাওয়ার আগ্রহ নেই তার। কারণ এসব দেশে কর্মীদের চুক্তিতে উল্লিখিত পরিমাণে মজুরি পরিশোধ করা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া তার নিজেরও এ-সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা খুব একটা ভালো নয়। এ কারণে তার ইচ্ছা, করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে এবার সিঙ্গাপুরে যাবেন হামিদ আলী। কারণ সেখানে প্রবাসী কর্মীদের বেতন-মজুরির পরিমাণ অন্যান্য দেশের চেয়ে তুলনামূলক বেশি বলে জানতে পেরেছেন তিনি।

হামিদ আলী জানান, ওমানে যাওয়ার আগে এজেন্সি যে চুক্তিপত্র দিয়েছিল, সেটিতে বাসস্থান ও খাবারের ব্যবস্থাসহ বেতন হওয়ার কথা ছিল ২৮ হাজার টাকার বেশি। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখা গেল, সব মিলিয়ে মাসে প্রায় ২১ হাজার টাকা করে বেতন পাচ্ছেন তিনি। কোম্পানি থেকে বাসস্থান দেয়া হলেও তিনবেলা নিজের খরচে খেতে হতো তাকে। সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতি মাসে গড়ে দেশে পাঠাতে পারতেন ১৫ হাজার টাকা করে। এটুকুর জন্য প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যে কঠোর পরিশ্রম করে যেতে হয়েছে তাকে। হামিদ আলী ওমান গিয়েছিলেন প্রায় ৩ লাখ টাকা খরচ করে। এ কারণে ফিরে আসাও সম্ভব হচ্ছিল না। তবে করোনার কারণে সব হিসাব বদলে গেছে। বর্তমানে তার ইচ্ছা তিনি সিঙ্গাপুরে যাবেন। সেখানে কাজ করেছেন এমন অনেক প্রবাসীর কাছে জানতে পেরেছেন, ওখানে ভালো বেতন পাওয়া যায়, আবার আবহাওয়াও প্রায় আমাদের দেশের মতো।

মজুরি নিয়ে প্রায় একই রকম অভিজ্ঞতা মালয়েশিয়া প্রবাসী রায়হানেরও। তিনি জানান, বুকিত বিনতাং এলাকার একটি আবাসিক হোটেলে পরিচ্ছন্নতা কর্মীর চাকরি নিয়ে ২০১৫ সালে মালয়েশিয়ায় যান তিনি। রিক্রুটিং এজেন্সি বলেছিল, মাসে প্রায় ৩০ হাজার টাকা বেতন দেয়া হবে। তবে মালয়েশিয়া গিয়ে দেখা গেল, মাসিক বেতন মিলছে সাকুল্যে ১৮ হাজার টাকা করে। বাকি টাকা কেটে রাখা হচ্ছে থাকা-খাওয়া বাবদ। দুই বছর পর বেতন বাড়ানো হলেও গত বছর কয়েক মাস অর্ধেক বেতন পেয়েছেন তিনি।

প্রবাসী কর্মীদের সঙ্গে বেতন নিয়ে বৈষম্যের বিষয়টি উঠে এসেছে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক সাম্প্রতিক সমীক্ষাতেও। অভিবাসী কর্মীদের নিয়ে বিবিএসের ‘অভিবাসন ব্যয় জরিপ’ শীর্ষক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বিদেশে যাওয়ার আগে চুক্তির সময় রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো যে বেতনের কথা বলে, প্রকৃতপক্ষে কর্মীরা সে অনুযায়ী বেতন পান না।

সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, অভিবাসী কর্মীদের সঙ্গে এজেন্সি এবং নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর চুক্তি অনুযায়ী সিঙ্গাপুরে একজন কর্মীর মাসিক গড় বেতন হওয়ার কথা ৪৬ হাজার ৮৯৫ টাকা। এছাড়া গড় বেতন সৌদি আরবে হওয়ার কথা ২৬ হাজার ১৮০ টাকা, ওমানে ২৭ হাজার, মালয়েশিয়ায় ২৯ হাজার ৭২৩ ও কাতারে ২৯ হাজার ১৭৪ টাকা। সব মিলিয়ে বিভিন্ন দেশে অভিবাসী কর্মীদের সঙ্গে এজেন্সি ও নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চুক্তি নির্ধারিত হয় মাসিক গড় বেতন ২৯ হাজার ৮৫৫ টাকা। এক্ষেত্রে চুক্তিপত্রে পুরুষ কর্মীদের তুলনায় নারী কর্মীদের বেতন ধরা হয় অনেক কম। চুক্তিপত্রে যেখানে পুরুষ কর্মীদের জন্য নির্ধারিত গড় মাসিক বেতন ৩২ হাজার ২৮৩ টাকা, সেখানে নারী কর্মীদের জন্য গড়ে ধরা হয় মাত্র ২০ হাজার ২১১ টাকা করে। অন্যদিকে গৃহকর্মীদের চুক্তিপত্রে নির্ধারিত মাসিক বেতনের গড় মাত্র ১৮ হাজার ৬০৯ টাকা। এক্ষেত্রে দক্ষ কর্মীদের জন্য গড় মাসিক আয় ধরা হয় ৩৪ হাজার ৭৩৪ টাকা করে। অদক্ষদের জন্য ধরা হয় ৩২ হাজার ৫৪ টাকা।

কিন্তু বাস্তবে বিদেশে যাওয়ার পর দেখা যাচ্ছে প্রবাসী কর্মীদের বেতন মিলছে চুক্তির চেয়ে কম পরিমাণে। এর মধ্যে তুলনামূলক কম পরিমাণে বেতন মিলছে মধ্যপ্রাচ্যের ওমান ও প্রধান শ্রমবাজার সৌদি আরবে। সৌদি আরব প্রবাসী বাংলাদেশী কর্মীদের গড় বেতন মাত্র ২৩ হাজার ৮০০ টাকা। দেশটিতে বাংলাদেশে পুরুষ কর্মীদের গড় বেতন ২৫ হাজার ৮০০ টাকা। নারী কর্মীদের ক্ষেত্রে গড় বেতন ১৭ হাজার ৩০০ টাকা। অন্যদিকে ওমানে পুরুষ কর্মীদের গড় আয় ২২ হাজার টাকা ও নারী কর্মীদের আয় ১৫ হাজার ৯০০ টাকা। মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ কাতারে প্রবাসী বাংলাদেশীদের মাসিক গড় আয় ২৪ হাজার ৯০০ টাকা। মালয়েশিয়ায় কর্মরত কর্মীদের গড় মাসিক বেতন ২৫ হাজার ৬০০ টাকা।

বিবিএসের সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, অভিবাসী কর্মীদের প্রকৃত মাসিক গড় বেতন মাত্র ২৫ হাজার ২৫৩ টাকা, যা নারী কর্মীর ক্ষেত্রে ১৭ হাজার ৩০২ টাকা। অন্যদিকে গৃহকর্মীদের প্রকৃত গড় মাসিক আয় মাত্র ১৬ হাজার ৪৬৭ টাকা। এছাড়া দক্ষ কর্মীদের প্রকৃত মাসিক গড় আয় ৩০ হাজার ৫৬১ টাকা ও অদক্ষদের ২৫ হাজার ৭০০ টাকা।

মাসিক বেতনের দিক থেকে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় রয়েছেন সিঙ্গাপুরে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশী কর্মীরা। দেশটিতে অবস্থানরত বাংলাদেশী পুরুষ কর্মীরা ৪০ হাজার ও নারী কর্মীরা ২২ হাজার টাকা করে গড় মাসিক বেতন পাচ্ছেন।

তবে বেতন বেশি হলেও সিঙ্গাপুরের অভিবাসন ব্যয় বেশি। মাদারীপুর থেকে যাওয়া আলাউদ্দিন প্রায় ১১ বছর ধরে সিঙ্গাপুরের কনস্ট্রাকশন ফার্মে কাজ করছেন। তিনি  বলেন, প্রথমে যখন চাকরি নিয়ে সিঙ্গাপুরে আমি যাই, তখন আমার বেতন ছিল ২৫ হাজার টাকা। বর্তমানে আমি মাসে প্রায় ৫০ হাজার টাকা করে পাচ্ছি। বাসস্থান ও খাবারের ব্যবস্থাও কোম্পানির পক্ষ থেকে করা হয়েছে। সিঙ্গাপুরে বেতন ভালো হলেও বর্তমানে অভিবাসন ব্যয় অনেক বেড়ে গিয়েছে। করোনার আগমুহূর্তেও যারা এখানে এসেছে, তাদের একেকজনের এখানে আসতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৭ থেকে ৯ লাখ টাকা। অভিবাসনের এ উচ্চব্যয় তুলতেই তাদের কয়েক বছর চলে যাবে।

জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) মহাসচিব (সাবেক) শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান জানান, সরকারি সমীক্ষায় প্রবাসী কর্মীদের বেতন-ভাতার একটি চিত্র উঠে এসেছে। কর্মীদের বেতন ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নির্ভর করে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর। কিছু ক্ষেত্রে বেতন কম দেয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। তবে কর্মীর দক্ষতা বাড়লে বেতন-ভাতা নিয়ে কোনো বৈষম্য থাকে না।

এমন আরো সংবাদ

Back to top button