সংস্কারের পর নির্বাচন
যোদ্ধা ডেস্কঃ ছাত্র জনতার এক অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যাত্রা শুরু হয়েছে। গত ৮ আগস্ট শপথগ্রহণের পর এ সরকারের কার্যক্রমের বয়স ১ মাস ৫ দিন পেরিয়েছে। এই সরকারের প্রতি জনসমর্থন যেমন রয়েছে, তেমনি জন প্রত্যাশাও অনেক বেশি। হাজার প্রাণের বিনিময়ে যে সফল বিপ্লব এসেছে তার মূল চেতনা হল বৈষ্যম্যের অবসান। একটি মানবিক ও ন্যায়ভিত্তিক বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে এই ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ অর্জিত হয়েছে। তাই নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে যে যাত্রা শুরু হয়েছে তাতে রাজনৈতিক দল এবং সকল শ্রেণী পেশার মানুষের সমর্থন এবং সহযোগিতা প্রয়োজন। একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন মানুষের প্রধান চাওয়া। তবে নির্ভয়ে-নির্দ্বিধায় ভোট দিতে পারা এবং ভোটের সুফল ভোগ করার মতো একটি রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন একটি নিরপেক্ষ প্রশাসন, শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা ইত্যাদির। তাই রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত নির্বাচনের আগে রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টরের অবশ্যই সংস্কার প্রয়োজন।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক, রাজনীতি বিশ্লেষক প্রফেসর ড. দিলারা চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, একটি অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের জন্য রাষ্ট্র সংস্কারের কোন বিকল্প নেই। কেননা বিগত স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট সরকার ১৫ বছরে রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টর ধ্বংস করে তার ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করেছিল। দেশকে একটি গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে হলে সব ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজন। ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস সংস্কারের রূপ রেখা উপস্থাপন করেছেন। ৬টি বিভাগে সংস্কারের জন্য ৬টি কমিশন গঠন করা হয়েছে। যাদের এই কমিশনগুলোর প্রধান করা হয়েছে তারা অত্যন্ত যোগ্য। তবে এই সব সংস্কারের জন্য প্রতিটি রাজনৈতিক দল এবং সকল জনগণকে এ জন্য সহযোগিতা এবং সমর্থন দিতে হবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান লক্ষ্য একটি অংশগ্রহণমূলক অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা। কেননা গত ১৬ বছর যাবৎ মানুষ তাদের ভোট নিতে পারেনি। সেই ক্ষোভ থেকেই অভ্যুত্থানের সূচনা। তাইতো নির্বাচনের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েই এ সরকার তার অন্যান্য সংস্কারের কাজগুলো দ্রুত এগিয়ে নিতে চায়। এ লক্ষ্যে গত ১১ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে রাষ্ট্র সংস্কারের একটি রূপ রেখা উপস্থাপন করেনে। প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে বলেন, নির্বাচন ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুলিশ প্রশাসন, জনপ্রশাসন, বিচার প্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন- এই চারটি প্রতিষ্ঠানের সংস্কার করা সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য। এসব বিষয়ে সংস্কার করার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে ছয়টি কমিশন গঠন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এসব কমিশনের কাজ পরিচালনার জন্য বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে ছয়জন বিশিষ্ট নাগরিককে কমিশনগুলো পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছি। এরপর আরো বিভিন্ন বিষয়ে কমিশন গঠন প্রক্রিয়া আমরা অব্যাহত রাখবো। ৬টি কমিশনের যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তারা হলেন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ড. বদিউল আলম মজুমদার, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে কাজ করবেন সরফরাজ হোসেন, বিচারবিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ড. ইফতেখারুজ্জামান, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী, সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে ড. শাহদীন মালিক দায়িত্ব পালন করবেন। এসব কমিশনের অন্য সদস্যদের নাম কমিশন প্রধানদের সাথে আলোচনা করে ঠিক করা হবে। কমিশনগুলোর আলোচনা ও পরামর্শ সভায় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, ছাত্র-শ্রমিক-জনতা আন্দোলনের প্রতিনিধি, নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন। এসব কমিশন আগামী ১ অক্টোবর কাজ শুরু করবে। এই ৬টি কমিশনের প্রধান হিসাবে যাদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে তারা সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। তাদের প্রত্যেকে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের সময়ের নানান অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেছেন। সরকারের হুমকি ধামকি উপেক্ষা করে তারা কথা বলেছেন। তাই তারা জনগণের চাওয়া পাওয়া কী সেটা ভাল করেই জানেন। সংস্কারের এ দায়িত্ব তারা যথাযথ ভাবে পালন করতে পারবেন বলে দেশের সব শ্রেণী পেশার মানুষ মনে করে।
সংস্কারের বিষয়ে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে সংবাদিকদের বলেন, সংস্কারের জন্য এ সরকার যে ছয়টি কমিশন গঠন করেছে তিন মাসের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন দেয়ার কথা রয়েছে। এরপর তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপে যাবে সরকার। সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক মতৈক্য গড়ে সংস্কার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার সুনির্দিষ্ট কোন কোন ক্ষেত্রে সংশোধনী এনে তারপরেই আমরা নির্বাচনের কথা ভাবছি। রাজনৈতিক দলগুলোও ইতোমধ্যে স্পষ্ট করেছে আগে সংস্কার তারপরে তারা নির্বাচনে যেতে চান।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, প্রধান উপদেষ্টা এবার যে ভাষণ দিয়েছেন তাতে তাদের কর্ম পদ্ধতির একটি মোটামুটি রূপরেখো উপস্থাপিত হয়েছে। তারা সংস্কারের জন্য ৬টি কমিশন গঠন করেছেন। আমরাও এসব সংস্কার হোক সেটা চাই। আমাদের যে ৩১ দফা পেশ করেছিলাম তাতে এ সব সংস্কারের বিষয় উল্লেখ আছে। এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসব সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছেন আমরা তাকে সাধুবাদ জানাই। তারা তিন মাসের মধ্যে এর রিপোর্ট পেশ করবে এটাও খুব যুক্তিসংগত বলেই আমরা মনে করি। এ সব সংস্কারের মধ্য দিয়ে একটি অবাধ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য এ সরকারের প্রতি আমাদের সকল প্রকার সহযোগিতা ও সমর্থন থাকবে।
ছাত্র জনতার এক অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে নতুন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছে তার সূচনা আরও অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে। মনে রাখতে হবে এই স্বৈরাচার শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে আন্দোলন সংগ্রাম করেছে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো। বিএনপি দলীয় সূত্র জানায়, গত ১৫ বছরে দলটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ৪২ হাজার ৮২৫টির বেশি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা ৫০ লাখ ৩২ হাজার ৬৫৫ জনের বেশি। এ ছাড়া ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে ৬০০ নেতাকর্মী গুম হয়েছে এবং সহস্রাধিক নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ কয়েকজন নেতার ফাঁসি হয়েছে। অনেক নেতা জেল জুলুম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বিএনপি জামায়াতের অনেক নেতা ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। অনেকে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র ফেরারি জীবন যাপন করেছেন। অনেকে দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর সাগরে ডুবেও মারা গেছেন। এ ছাড়া অন্যান্য দলের নেতারাও এ সরকারের জুলুমের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ক এে হারি০ে০ নেতাকর্মীকে গুম কৈেু হিেতটি সেক্টর নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্নাও কারানির্যাতন ভোগ করেছেন। বিগত জালিম সরকারের নির্যাতনের শিকার আলেম সমাজও। বিশেষ করে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের উপর সরকারের বর্বরোচিত হামলা এখনো মানুষের মনে দাগ কেটে আছে। ছোট ছোট মাদ্রাসার হাফেজদের উপর গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তাদের অনেককে হত্যা করা হয়েছিল। অনেক আলেম উলামা জেল খেটেছেন। নানান জুলুম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বিগত ১৫ বছর ধরেই সরকারের বিরুদ্ধে এভাবে আন্দোলন সংগ্রাম চলেছে। এর সফল পরিণতি হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে গড়ে ওঠা ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে। তাই এই আন্দোলনের সমন্বয়কদের কৃতিত্ব অবশ্যই সবার স্মরণ রাখতে হবে। তাদের বীরত্ব গাঁথাকে সামনে রেখেই দেশ পুনর্গঠনের কাজ এগিয়ে নিতে হবে। এ গণ অভ্যুত্থান সফল হওয়ার পিছনে সেনাবাহিনী প্রধান লেফটেনেন্ট জেনারেল ওয়াকার উজ জামানের ভূমিকাও অত্যন্ত প্রশংসনীয়। সফল অভ্যুত্থান এবং এর পরবর্তী সঙ্কটে তিনি অত্যন্ত ধৈর্য্য ও সাহসের সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন।
শুধু রাজপথের আন্দোলনই নয় ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে দেশ বিদেশের সোশ্যাল মিডিয়াও বিশাল অবদান রেখেছে। বিশেষ করে পিনাকী ভট্টাচার্য ইউটিউবে এবং অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার রাজনৈতিক বিশ্লেষণ দিয়ে এদেশের মানুষকে অনেক সচেতন করেছেন। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে তার ভূমিকাকেও খাটো করে দেখলে চলবে না। এ ছাড়া সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারিও আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টে হাসিনা সরকারের নানান অনিয়ম দুর্নীতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয় তুলে ধরে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। এ ছাড়া ইলিয়াস হোসেন, কনক সারোয়ার, নাজমুস সাকিবসহ আরও অনেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় সরকারের বিরুদ্ধে নানান প্রচার প্রচারণা চালিয়ে দেশের জনগণকে সচেতন করতে সহায়তা করেছেন। তাদের সবার ভূমিকাকেই স্মরণ রাখতে হবে। দেশ গঠনের এ যাত্রায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থেকে এ সরকারের কাজে সমর্থন এবং সহযোগিতা দিতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বয়স মাত্র এক মাস পেরিয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন পেশাজীবীরা তাদের দাবি নিয়ে রাজপথ, সচিবালয় ঘেরাও করছেন। তাদের দাবি যৌক্তিক হলেও তা আদায়ের সঠিক সময় এবং সঠিক পথ এটা নয়। সরকার সবার যৌক্তিক দাবি পূরণের কথা বারবার ব্যক্ত করছেন। ইতোমধ্যে পর্যায় ক্রমে তা পূরণ করাও হচ্ছে। তাই সবাইকে ধৈর্য্য ধরে এ সরকারকে কাজ করতে দিতে হবে। সরকার যদি কোন প্রকার ঝামেলা ছাড়া একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করতে পারে তাহলে দেশে সত্যি সত্যি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারবে এমনটাই বিশেষজ্ঞদের অভিমত। সম্ভাব্য সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ড. বদিউল আলম মজুমদার ইনকিলাবকে বলেন, এখনো কমিশনের টার্ম অব রেফারেন্স কি হবে সেটা পাইনি। তবে যতটুকু বুঝতে পারছি, এই কমিশনের কাজ হবে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করা। যাতে নির্বাচন কমিশন ভবিষ্যতে জাতির প্রত্যাশা অনুযায়ী অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করতে পারে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের প্রেক্ষিত এবং ছাত্র-জনতার আন্দোলনের যে মূলমন্ত্র, রাষ্ট্র সংস্কারে সেটিও বিবেচনায় রাখতে হবে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পাওয়া ড. শাহদীন মালিক ইনকিলাবকে বলেন, ‘টার্মস অব রেফারেন্স না পেলে এখনই কিছু বলা সম্ভব না। আগে পুরো কমিশন গঠন হোক, সরকার টার্মস অব রেফারেন্স ঠিক করুক, তারপরই এ ব্যাপারে মন্তব্য করা যাবে। ফলে এখন কিছু বললে সেটা আগ বাড়িয়ে বলা হবে।’