তিস্তাকে গলাটিপে হত্যা করেছে হাসিনা
তিস্তাকে গলাটিপে হত্যা করেছে হাসিনা
চার বছর পর রংপুরে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী ২ আগস্ট রংপুরে জনসভা করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় তার কাছে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও বিশেষ করে এ বিভাগের ৮ জেলায় শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার, উন্নয়ন এবং সরকারি চাকরি বৃদ্ধির কোটার ঘোষণা তুলবেন রংপুর বিভাগের মানুষ। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কাছে রংপুরবাসীর নানা প্রত্যাশা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে আশায় বুক বাঁধছেন তিস্তাপাড়ের মানুষরা।
তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের কয়েক হাজার নেতাকর্মী ও তিস্তাপারের মানুষ ২ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর জনসভায় ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে উপস্থিত হয়ে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ঘোষণার দাবি জানাবে বিভিন্ন সংগঠন। তিস্তাপাড়ের সাধারণ মানুষ এবং তিস্তা নিয়ে যারা আন্দোলন করে আসছেন, তাদের আশা প্রধানমন্ত্রী রংপুরের জনসভায় বহু আকাঙ্ক্ষিত তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে কোনো সুখবর নিশ্চয়ই দেবেন। কারণ, পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়ায় তিস্তা এখন উত্তরের মানুষের দুঃখ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবছর বন্যা এবং খরায় নদীপাড়ের মানুষের দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। তিস্তার দুই পাড়ের লাখ লাখ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করতে পারে একমাত্র মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হলে তিস্তাপাড়ের মানুষের পানির জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না।
উলিপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি হায়দার আলী মিয়া ইনকিলাবকে পতিত হাসিনা সরকারে গত ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগে রংপুরের দুটি জনসভায় যোগ দিয়ে তিস্তা নিয়ে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বাস্তবে এর কোনো কাজ করেনি। শেখ হাসিনা তিস্তা নদীকে শেখ হাসিনা গলাটিপে হত্যা করেছে।
প্রায় ২৪০ বছরের পুরোনো নদী তিস্তা। এর সঙ্গে উত্তরের ২৫টি নদীর সঙ্গে প্রবাহ বইছে। গত ২০১৪ সাল থেকে ভারত সরকার একতরফাভাবে তিস্তার পানি প্রত্যাহার করছে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে নদীটি একেবারেই শুকিয়ে যায়। নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম জেলার রাজাহাট, উলিপুর, চিলমারী, রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা,গাইবান্দার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে তিস্তা। তবে শুষ্ক মৌসুমে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলা। এ উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের মধ্যে ৭টিই তিস্তা নদীবেষ্টিত। নদীশাসন না হওয়ায় গত পাঁচ বছরে গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে।
গত ২০১৭ সালে ভারী বর্ষণ ও উজানের পানিতে গঙ্গাচড়া উপজেলার এসকেএসের বাজার, পূর্ব ইচলী ও সিরাজুল মার্কেটের পাশ দিয়ে তিস্তা নদীর নতুন প্রবাহ তৈরি হয়। ওই বছর রেকর্ড পরিমাণ বন্যায় তিস্তার চর ও দ্বীপচর থেকে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় স্পিডবোটে করে উদ্ধার কার্যক্রম চালানো হয়েছিল। সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে কুড়িগ্রাম রংপুরসহ অন্যান্য জেলার বন্যা পর্যবেক্ষণ করেন সেনাবাহিনী, প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা। তিস্তা খনন না হওয়ায় উজানের পাহাড়ি ঢলে প্রতিবছর পলি পড়ছে। এতে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। জেগে উঠছে নতুন নতুন চর। পরবর্তীতে বর্ষায় পানি ধারণক্ষমতা কমে যাওয়ায় নতুন নতুন দিক থেকে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এতে ঘরবাড়ি, আবাদি জমি, অবকাঠামো নদীতে চলে যাচ্ছে। কয়েক বছর ধরে তিস্তার বামতীরে থাকা অধিবাসীরা তিস্তার কবল থেকে রক্ষা পেতে বাঁধের দাবি করে আসছে। এদিকে গত বছরের ৯ অক্টোবর রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের পতিত সরকারে মন্ত্রীরাসহ আশপাশের এলাকা পরিদর্শন করেছেন চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং। তিস্তাপারের মানুষের সঙ্গে কথা বলাসহ সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য তিনি এসেছেন বলে সেই সময় চীনা রাষ্ট্রদূত জানান। সেই সঙ্গে তিনি তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে চীনের ইতিবাচক সাড়ার কথা ব্যক্ত করেন।
চীনা রাষ্ট্রদূতের তিস্তা এলাকা পরিদর্শন দেখে আশায় বুক বেঁধেছিল তিস্তাপারের মানুষ। কিন্তু ১৫ বছর পার হলেও তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের নেতারা বক্তব্য দিচ্ছেন।
তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সফিয়ার রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রী রংপুরের পুত্রবধূ। ২০১১ থেকে ২০১২ সালের দিকে যখন ভারতের সঙ্গে পানিচুক্তি হলো না, তখন তিনি তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা জানিয়েছিলেন। আমরা সেই সময় তিস্তাপারের লক্ষাধিক মানুষ প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে বিশাল মিছিল ও সমাবেশ করেছিলাম। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্যÑসেটি এক যুগেও বাস্তবায়ন হয়নি। রংপুর বিভাগে দরিদ্রতার হার সর্বোচ্চ আর বরাদ্দ সর্বনিম্ন। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে অববাহিকার এক কোটি মানুষ উপকৃত হবে। এতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিস্তাপারের ১৩ থেকে ১৪টি উপজেলা ও ১১টি সংসদীয় আসনের ২৫ থেকে ৩০ লাখ ভোটার প্রধানমন্ত্রীর ওপর আস্থা আনবে। তিনি বলেন, তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের কয়েক হাজার নেতাকর্মী ও তিস্তাপারের মানুষ গত বছর ২ আগস্ট সাবেক পতিত প্রধানমন্ত্রীর জনসভায় ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে উপস্থিত হয়ে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ঘোষণার দাবি জানাবে।
রিভারাইন পিপলের পরিচালক অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদ ইনকিলাবকে বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হলে যুগের পর যুগ তিস্তাপারের মানুষকে খরা-বন্যা ও ভাঙনের সঙ্গে সংগ্রাম করতে হবে। মানুষ দরিদ্র থেকে দরিদ্র হচ্ছে, বাড়ছে নদীশাসনের চ্যালেঞ্জ। অপরদিকে তিস্তার প্রবাহ ঠিক না থাকলে সাগরের লবণপানি লোকালয়ে উঠে আসবে। এতে ফসল আবাদ, মাছ চাষ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। তাই আমরা চাই উত্তরের মানুষের কথা ভেবে এ জনসভায় প্রধানমন্ত্রী বহুল প্রত্যাশিত তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়ে রংপুরবাসীর স্বপ্নকে একধাপ দেখিয়ে নেবেন।
তিস্তা নদীর উজানে খাল ও ব্যারেজ নির্মাণের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে ভারত তিস্তার প্রায় সবটুকু পানিই প্রত্যাহার করে আসছে। এর ফলে শুষ্ক মৌসুমে কৃষির প্রয়োজনীয় সেচে বিপাকে পড়েন উত্তরাঞ্চলের কৃষকরা। অপরদিকে বর্ষা মৌসুমে তিস্তার পাহাড়ি ঢলের তোপের মুখে ভারত তার ব্যারেজগুলোর মুখ খুলে দেয়ায় সেখান থেকে নেমে আসা পানিতে প্রতিবছরই বন্যায় প্লাবিত হয় এ অঞ্চলের বিস্তীর্ণ জনপদ। খরা মৌসুমে পানি না পাওয়া এবং বর্ষা মৌসুমে অতিপ্রবাহের কারণে তিস্তা নদী গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই অঞ্চলের মানুষের জন্য। পাশাপাশি বিষয়টি ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কের মাঝেও কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ পরিস্থিতিতে তিস্তাকে ঘিরে উন্নয়ন প্রকল্পে আগ্রহ প্রকাশ করেছে চীন। তিস্তার পানি ব্যবস্থাপনাসহ নদীকে ঘিরে নানা অর্থনৈতিক পরিকল্পনার কথা জানায় বেইজিং। চীনের এই আগ্রহে হঠাৎ করেই নতুন করে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে তিস্তা নদী। বাংলাদেশে আন্তঃসীমান্ত নদীর সংখ্যা নিয়ে আছে বিভ্রান্তি। স্বীকৃত নদীর সংখ্যা ৫৭ বলা হলেও গবেষকরা দাবি করেছেন, এর বাইরে আরও ৬৯টি আন্তঃসীমান্ত নদী আছে। আন্তঃসীমান্ত নদী হিসেবে কোথাও এর স্বীকৃতি বা নথিভুক্তি নেই। নদীর অধিকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া এবং স্বীকৃতি না মেলায় উজানে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে ভারত। ফলে বাংলাদেশের ভাটি অংশে প্রয়োজনের সময় বিশেষ করে শুকনা মৌসুমে পর্যাপ্ত পানি প্রবাহিত হয় না। আবার অতিরিক্ত পানি সামলানোর নামে বর্ষা মৌসুমে বাঁধের কপাট খুলে দেওয়ায় ভাটি এলাকা বন্যায় ডোবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভিন্ন নদীর পানির হিস্যা নিয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রের নানা বাহানা উজানে থাকা বাংলাদেশকে ক্ষতির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। আঞ্চলিক ও দ্বিপক্ষীয় শান্তির জন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে সুসম্পর্ক এবং পারস্পরিক আস্থা থাকা জরুরি।
উজানের ঢলে প্রতিবছরই বাংলাদেশ আকস্মিক বন্যার মুখে পড়ে। কুমিল্লার ওপর দিয়ে প্রবাহিত গোমতী ও ফেনীর ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া মুহুরী নদীর উজানে ত্রিপুরা রাজ্যে একাধিক ড্যাম তৈরি করেছে ভারত সরকার, সঙ্গে রয়েছে ব্যারাজ। এভাবে নদী অববাহিকার উপনদীগুলোতেও রয়েছে একাধিক বাঁধের অস্তিত্ব। প্রবল বর্ষণে নদী অববাহিকার উজানে পানির চাপ বেড়ে যাওয়ায় হঠাৎ এই ড্যাম ও ব্যারাজ খুলে দিলে পানির প্রবল স্রোতে ভাটি অঞ্চল তলিয়ে যায়। অথচ এই বাঁধ খুলে দেওয়ার বিষয়টি জানে না বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশন।
৬৯ নদীর স্বীকৃতি নেই, চুক্তি শুধু গঙ্গা নিয়েই।