দেশ

রক্তাক্ত ঢাবি ক্যাম্পাস

যোদ্ধা ডেস্কঃ কোটা সংস্কারের দাবিতে বিগত কয়েকদিন ধরে চলা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ছাত্রলীগের হামলায় রক্তাক্ত হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ (ঢাবি) দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। ঢাবির বিজয় একাত্তর হলের সামনে থেকে শুরু হওয়া সংঘর্ষে রণক্ষেত্র হয়ে পড়ে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। ছাত্রলীগ ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে দফায় দফায় ঘটে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ইট-পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা। লাঠিসোঁটা, রড, হকিস্টিক, জিআই পাইপ, স্ট্যামসহ দেশীয় অস্ত্রের মুখে টিকতে না পেরে ছাত্রলীগের হাতে বেধড়ক মারধরের শিকার হয়েছেন কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীরা। ছাত্রলীগের হামলা ও মারধরে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেই আড়াই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মলচত্বর, টিএসসি এলাকায় হামলায় আহত হয়ে শিক্ষার্থীরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে হাসপাতালের ভেতরেও হামলা চালায় ছাত্রলীগ। ফলে ওই এলাকায়ও ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপেরে ঘটনা ঘটে। এসময় সাধারণ শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে হেলমেট পরিহিত একজনকে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে গুলি করতেও দেখা যায়। এছাড়া ওই এলাকায় কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটে। একই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপরও হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ। এর প্রতিবাদে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা। দুপুর থেকে বিকেল অবধি চলা এই সংঘর্ষের পর লাঠিসোটা হাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মহড়া দেয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। সংঘর্ষের পুরোটা সময়ই এবং ছাত্রদের ওপর হামলার ঘটনা দেশেও পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে বলে অভিযোগ করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তবে গতকাল সোমবার রাতে এই রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত ধমধমে পরিস্থিতি বিরাজ করছিল।
জানা যায়, কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে এবং বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবিতে গতকাল সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে জড়ো হতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। সেখানে তারা সমাবেশও শুরু করেন। এর এক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের সামনে কোটা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। হামলায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অনেকেই মারধরের শিকার হন। এক পর্যায়ে টিএসসি থেকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের কিছু অংশ তাদের সাথে যুক্ত হলে ছাত্রলীগের সঙ্গে তাদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের একপর্যায়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ভিসির বাসভবনের সামনের জায়গা থেকে পিছু হটেন। তাঁদের একটি দল ফুলার রোড হয়ে এবং আরেকটি দল স্যার এ এফ রহমান হলের সামনের রাস্তা দিয়ে নীলক্ষেতের দিকে সরে যায়। অপর দিকে বিজয় একাত্তর হলের সামনে ছাত্রলীগ নেতা–কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ চালিয়ে আসা শিক্ষার্থীরাও বিকেল চারটার দিকে পিছু হটেন। এসময় ছাত্রলীগ লাঠিসোটা, রড, হকিস্টিক, স্ট্যাম্প, জিআই পাইপসহ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দেয় এবং বিচ্ছিন্নভাবে যাদের যেখানে পেয়েছে সেখানে বেধড়ক পেটানো হয়। এতে বাদ যায়নি নারী শিক্ষার্থীরাও। তাদের হামলা ও মারধরে অনেক শিক্ষার্থী ভয়াবহ জখম ও রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। কিন্তু তারপরও তাদের ওপর চলে হামলা ও লাঠিপেটা।
কোটা সংস্কারের আন্দোলনকারীদের অভিযোগ ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের সাথে পেরে না উঠে মুহুর্তেই ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ক্যাম্পাসে নিয়ে আসে। বেলা গড়াতেই ব্যাপক বহিরাগত যুবকের দেখা মিলে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনরত নারী শিক্ষার্থীদের উপর হামলা না করলেও বহিরাগত এসব যুবক খুঁজে খুঁজে নারী শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করে বলে অভিযোগ করেছেন আহত শিক্ষার্থীরা। হামলায় আহত এক নারী শিক্ষার্থী নিজের ফেসবুকে লাইভে এসে কান্নায় ভেঙে পড়ে বলতে শোনা যায়, ‘আজ নিজ ক্যাম্পাসেই নিজে বহিরাগত হলাম!’ তিনি বলেন, ছাত্রলীগ আমাদের ক্যাম্পাসেই বহিরাগত এনে আমাদের আঘাত করেছে। বেলা গড়াতেই ছাত্রলীগের হাজার হাজার নেতাকর্মীদের উপস্থিতি দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। রড, জিআই পাইপ ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ক্যাম্পাস জুড়ে মিছিল দিতে দেখা যায় তাদের। দফায় দফায় শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করেন তারা। হামলায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অন্তত আড়াই শতাধিক আহত হয় বলে জানিয়েছেন আন্দোলনকারীদের প্লাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
ছাত্রলীগের বেপরোয়া হামলার মুখে টিকতে না পেরে বেলা সাড়ে ৩টার দিকে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে শিক্ষার্থীরা। আহত শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। অতঃপর পুরো ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ মহড়া দিতে দেখা যায়। এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন জায়গায় খুঁজে খুঁজে শিক্ষার্থীদের মারধর করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। আতঙ্কে ক্যাম্পাসের সাধারণ মানুষও দিকবিদিক ছুটাছুটি করতে থাকেন। কোটা বিরোধী আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ভেবে এমন অনেক সাধারণ মানুষের উপরও ছাত্রলীগের ঝাপিয়ে পড়ার সংবাদ পাওয়া গেছে।
বিকাল ৫টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সড়ক অতিক্রম করে মিছিল নিয়ে ছাত্রলীগের কয়েক হাজার নেতাকর্মী ঢাকা মেডিক্যালের সামনে জড়ো হয়। আরেকটি দল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল সংলগ্ন দোয়েল চত্বর এলাকায় অবস্থান নেয়। এসময় মাঝখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হল, ফজলুল হক মুসলিম হল ও অমর একুশে হলের শিক্ষার্থীরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মুহুর্তেই রণক্ষেত্রে পরিণত হয় পুরো চাঁনখারপুল, ঢাকা মেডিক্যাল ও দোয়েল চত্বর এলাকা।
বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে ঢাকা মেডিক্যালের ইমার্জেন্সি বিভাগের ভেতর দফায় দফায় হামলা করে ছাত্রলীগ। এসময় পুরো মেডিক্যালের রোগিদের মাঝেও ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এসময় শহীদুল্লাহ হলের সামনে অবস্থান নেওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের সাথে কার্জন হলের সামনে অবস্থান নেওয়া ছাত্রলীগের সহস্রাধিক নেতাকর্মীর সাথে দফায় দফায় সংঘর্ষ ঘটে। ইট পাটকেলের পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। শটগানের শব্দ কিংবা ককটেললর শব্দও শোনা যায় অন্তত ৮বার। এসময় দফায় দফায় এই সংঘর্ষ আহত হয় অনেক শিক্ষার্থী। ছাত্রলীগেরও কয়েকজন নেতাকর্মী আহত হওয়ার সংবাদ পাওয়া গেছে।
১৪ জুলাই গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য ‘মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা কিছুই পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা সব পাবে?’ বক্তব্যের প্রতিবাদে গত রোববার রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সস দেশের বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে রাস্তায় নামেন। ইডেন কলেজের ছাত্রীদের ঠেকাতে কলেজের মূল ফটক বন্ধ করে রাখা হয়। কিন্তু ছাত্রীরা ফটকের তালা ভেঙ্গে প্রতিবাদ আন্দোলনের মিছিলে শরিক হন। এতে বিক্ষুব্ধ হয়ে ছাত্রলীগ ইডেন কলেজে হামলা করে। রাত ১২ টার পর শিক্ষার্থীর হল থেকে বের হয়ে প্রতিবাদ করতে থাকে। এমনক গভীর রাতে ছাত্রী হলগুলো থেকে শত শত ছাত্রী বের হয়ে ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ করতে থাকেন। এরপর ভয়ঙ্কররূপে মাঠে নামে ছাত্রলীগ।
শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড, রামপুরা, নতুন বাজার, স্যায়েন্স ল্যাব, শেরেবাংলা নগর, মহাখালিসহ বিভিন্ন স্পটে শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানান।  ইনকিলাবের ঢট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা জানান, শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা ঠেকানোর চেষ্টা করলে প্রক্টরের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
রড-কুড়াল নিয়ে ঢামেকে হামলা : বিকাল থেকে বেশ কয়েকবার চেষ্টা চালানোর পর অবশেষে রাত সাড়ে ৭টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ঢুকে হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হেলমেট পরে, লাঠিসোঁটা নিয়ে ঢামেকে প্রবেশ করে। এসময় অনেকের হাতে রড ও চাইনিজ কুড়াল দেখা যায়। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা কোটা সংস্কার আন্দোলনে আহত কয়েকজন শিক্ষার্থীর ওপর আবারও হামলা চালায়। এছাড়াও ঢামেকে দাঁড়িয়ে থাকা বেশ কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্সও ভাঙচুর করে তারা। পরবর্তীতে উপস্থিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের জরুরি বিভাগে ঢুকতে বাধা দেয়। এসময় তারা বেশ কয়েকজন সাংবাদিকদের ওপরে চড়াও হয়। এসময় পুরো হাসপাতাল এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করে।
ইডেন কলেজে হামলা : রাজধানীর ইডেন কলেজ শাখা সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি শাহিনুর সুমি আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে কোটা সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভে যেতে ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীদের ছাত্রলীগ বাধা দেয় এবং মারধর করে। এতে সুমি আহত হন। সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক রাফিকুজ্জামান ফরিদ বলেন, দুপুরে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে যোগ দিতে ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এ সময় ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর গরম পানি ঢেলে দেন এবং মারধর করেন। এতে সুমিসহ কয়েকজন আহত হন। তিনি এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের (মার্ক্সবাদী) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক মোজাম্মেল হক বলেন, ইডেন কলেজে ছাত্রলীগ আন্দোলনকারী ছাত্রীদের ওপর হামলা করেছে। হামলায় আহত হয়েছেন ছাত্র ফ্রন্টের ঢাকা মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক সায়মা আফরোজ, ইডেন কলেজ শাখার সভাপতি শাহিনুর সুমি, সাংগঠনিক সম্পাদক সুমাইয়া সাইনা, অর্থ সম্পাদক সানজিদা হক এবং গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের ঢাকা মহানগরের সংগঠক স্কাইয়াসহ অনেকে।
কর্মসূচি ঘোষণা: নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে কোটা আন্দোলনকারীরা। সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের ন্যাক্কারজনক হামলার প্রতিবাদে আজ মঙ্গলবার বিকাল ৩টায় দেশের প্রত্যেক ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।  এই আন্দোলনে দেশের সবাইকে গণজমায়েতের আহ্বান জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। গতকাল রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের সামনে সংবাদ সম্মেলনে এ কর্মসূচির ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা। নাহিদ ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য আমরা প্রত্যাখ্যান করি ও নিন্দা জানাই। তার এমন বক্তব্যে দুঃখ প্রকাশ করতে হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কুড়িল-বিশ্বরোড অবরোধ : কোটা সংস্কারের দাবিতে রাজধানীর নতুন বাজার, কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় সড়ক অবরোধ করেছে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সোমবার দুপুর থেকে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে রাখেন। এতে আশেপাশের সড়কে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়।
ট্রাফিক পুলিশের গুলশান বিভাগ জানিয়েছে, বেলা ২টার দিকে আফতাবনগরের সামনের সড়ক অবরোধ করেন ব্র্যাক ও ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বেলা ৪টার দিকে নতুন বাজারের সড়কে নেমে যান চলাচল আটকে দেয় ইউআইইউসহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। পৌনে ৫টায় নতুন বাজারের অবরোধকারীরা সড়ক ছেড়ে দেন। এছাড়া কুড়িল এলাকাতেও কিছু শিক্ষার্থী সড়কে বিক্ষোভ করেছে।
ট্রাফিক পুলিশের গুলশান বিভাগের এডিসি হাফিজুর রহমান বলেন, কিছু শিক্ষার্থী সড়কে অবরোধ করায় যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ফেইসবুক গ্রুপ ‘প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট অ্যালায়েন্স অব বাংলাদেশ’ এ বলা হচ্ছে, নতুন বাজার, আফতাবনগর ও যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে পৃথকভাবে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সমর্থনে রাস্তায় নেমেছে ব্র্যাক, নর্থসাউথ, ইস্টওয়েস্ট ও ইউআইইউর শিক্ষার্থীরা।
এদিকে সরকারি চাকরির সব গ্রেডে যৌক্তিক কোটা সংস্কারের দাবিতে রাজধানীর নতুন বাজার এলাকায় আন্দোলন করছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকর্শ শিক্ষার্থী জড়ো হয়ে রাস্তা অবরোধ করে এই আন্দোলন করেন। ফলে নতুন বাজার এলাকায় যান চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে।
শিক্ষার্থীর দুপুরে সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন শুরু করেন। সমাবেশে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘কে রাজাকার কে রাজাকার, তুই রাজাকার, তুই রাজাকার’, ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’, ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’সহ বিভিন্ন সেøাগান দিতে দেখা যায়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নতুন বাজার এলাকায় পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ আনার জন্য চেষ্টা করছেন।
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) বাড্ডা জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) রাজন কুমার সাহা বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করে আন্দোলন করছেন। তারা সরকারি চাকরিতে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন করছেন। আমরা শিক্ষার্থীদের বুঝাচ্ছি তারা যেন রাস্তা ছেড়ে চলে যান।
প্রক্টরের সাথে ধস্তাধস্তি ছাত্রলীগের চবি সংবাদদাতা জানান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের বাঁধাদান ও সমন্বয়ককে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে মিছিল করা ও শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। এতে অন্তত দুইজনের আহতের খবর পাওয়া গেছে। গতকাল সোমবার দুপুর আড়ায়টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেলওয়ে স্টেশনে এসব ঘটনা ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, দুপুর আড়ায়টার কোটা সংস্কার আন্দোলনে যুক্ত শিক্ষার্থীরা শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার প্রস্তুতি নেয়। এর আগে থেকে থেকে শাটল ট্রেনের বগিতে বগিতে তদারকি করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এসময় চবি কোটা সংস্কার আন্দোলনের সহ সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফিকে দেখে ঘিরে ধরে ছাত্রলীগের বিভিন্ন উপগ্রুপের নেতারা। ধস্তাধস্তি করে তাকে তুলে নিয়ে যায় যাওয়া হয়। পরে রাফিকে নিয়ে ছাত্রলীগের একটি মিছিল প্রক্টর অফিসে গিয়ে প্রক্টরের কাছে তাকে তুলে দেয়।
এ সময় শাখা ছাত্রলীগের নেতারা বলেন, যারা রাজাকার পরিচয় দিয়েছে তাদের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটিতে ঠাঁই নাই। যে ছেলে কোটা সুবিধা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ কোটার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এদের পেছনে কোন অপশক্তির ইন্ধন আছে কিনা খতিয়ে দেখতে হবে। এদের ছাত্রত্ব বাতিল করতে হবে। এদিকে আন্দোলনের সমন্বয়ক রাফিকে তুলে নেয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। মেয়েদের হল থেকে অনেক মেয়ে প্রক্টর অফিসের সামনে চলে আসেন। পূর্ব থেকেই ছাত্রলীগের অবস্থান থাকায় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে জানা যায়, শিক্ষার্থী বিক্ষোভে বাধা দিতে শাটল ট্রেন অফ করে দেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে হামলার খবর পেয়ে প্রক্টর আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সাথে পর্যবেক্ষণে যেতে চাইলে ছাত্রলীগের বাধার সম্মুখীন হন। এসময় প্রক্টরের সাথে ধস্তাধস্তি হয় ছাত্রলীগ কর্মীদের। পরে প্রক্টর পুনরায় তার কার্যালয়ে প্রবেশ করতে বাধ্য হন।
এর আগে আন্দোলনকারীদের একটি অংশ প্রক্টর অফিসের দিকে আসার সময় দুইজন শিক্ষার্থী আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। আহতদের তথ্য জানা জানা যায়নি।
সরেজমিন দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত মেয়ে শিক্ষার্থীরা প্রক্টর অফিসের সামনে অবস্থান নেয়। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের অবরুদ্ধ করে রাখে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থলে কোন পুলিশ সদস্যের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়নি। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের একটি অংশ চট্টগ্রাম শহরে অবস্থান নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর ড. মোহাম্মদ অহিদুল আলম বলেন, শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে আমাদের সমর্থন ছিল। আমরা জানি তারা সবাই সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে আন্দোলন করছে। কিন্তু গতকাল শিক্ষার্থীরা যেভাবে সেøাগান দিয়ে আন্দোলন করছে তখন থেকে মনে হচ্ছে এই আন্দোলন ভিন্ন দিকে যাচ্ছে।
প্রক্টর বলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয় আইন, আদালতকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আমাদের পদক্ষেপ নিব। কেউ আইন আদালতের বিরুদ্ধে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এর দায় নিবে না।
প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের প্রতিবাদে রাবি-রুয়েট শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ রাবি সংবাদদাতা জানান, মুক্তিযোদ্ধা কোটা সুবিধা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ও রাজশাহী প্রকৌশল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গতকাল সোমবার বেলা সাড়ে ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোডে এ বিক্ষোভ কর্মসূচি করেন শিক্ষার্থীরা। এসময় রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এক বিশাল সমাবেশ নিয়ে রাবি শিক্ষার্থীদের সাথে যোগদান করেন। তুমি নও আমি নই রাজাকার রাজাকার, কে বলছে কে বলেছে সংবিধান সংবিধান, তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার, চেয়েছিলাম অধিকার হয়ে গেলাম রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে সরকার সরকার’ এমনসব সেøাগানে বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল করে তুলেছেন শিক্ষার্থীরা।
সমাজকর্ম বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আলফাজ বলেন, আমরা এতোদিন যৌক্তিক দাবি নিয়ে আন্দোলন করেছিলাম। রাষ্ট্রের যাদের কাছে আমাদের দাবি তারাই যদি আমাদের সাথে এমন আচরণ করে তাহলে আমরা যাবো কোথায়? প্রধানমন্ত্রীর এমন মন্তব্যের প্রতিবাদ কিন্তু সারাদেশের ছাত্র সমাজ কালকে রাষ্টের তই তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এমন মন্তব্য আমরা সকল শিক্ষার্থীরা আজকের এ কর্মসূচি পালন করছি। প্রধানমন্ত্রী তার ভুল বুঝে ছাত্র সমাজের দাবি মেনে নিবে বলে আমি আশাবাদী।
রুয়েট শিক্ষার্থী মো. আলমাস হোসাইন বলেন, বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বাংলাদেশের ছাত্র সমাজের জন্য অপমানজনক। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এধরনের মন্তব্য আমরা কখনোই আশা করিনা। আমরা আমাদের অধিকার আদায়ের জন্য রাজপথে নেমেছি অথচ আমাদেরকে রাজাকার বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে ৷ আমরা ছাত্রসমাজ এই মন্তব্যের বিরোধিতা করি এবং সকল গ্রেডে কোটা ব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কার চাই, সেই সাথে কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় এই আন্দোলনকে ঘিরে ছাত্রদের উপর যে সন্ত্রাসী হামলা ও নির্যাতন চালানো হয়েছে তার জবাব চাই। আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাব। এসময় প্রায় বিভিন্ন হলের আট শতাধিক শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন।
চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার : বিক্ষোভ মিছিলে কুবি শিক্ষার্থীরাকুবি সংবাদদাতা জানান, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহার এবং কোটা সংস্কারের এক দফা দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) শিক্ষার্থীরা। গতকাল সোমবার বিকাল ৩টায় বিক্ষোভ মিছিল করে তারা। বিক্ষোভ মিছিল ছাত্র আন্দোলন চত্বর থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গোল চত্বরে এসে শেষ হয়।
এ সময় তারা ‘লাখো শহিদের রক্তে কেনা দেশটা কারো বাবার না, চেয়েছিলাম অধিকার হয়ে গেলাম রাজাকার আমি নই তুমি নই রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে? কে বলেছে? সরকার সরকার? এসব সেøাগান দিতে থাকেন। পরে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সিসিএন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ও অংশ নেয়।
কোটা আন্দোলনকারীদের মিছিলের প্রতিবাদে ইবি ছাত্রলীগের পাল্টা বিক্ষোভ ইবি সংবাদদাতা জানান, কোটা পদ্ধতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে কোটা আন্দোলনকারীদের মিছিলের প্রতিবাদে পাল্টা বিক্ষোভ মিছিল ও ছাত্রসমাবেশ করেছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) শাখা ছাত্রলীগ। সোমবার বেলা সাড়ে ১১টায় সংগঠনটির দলীয় টেন্ট থেকে মিছিল শুরু হয়। মিছিলটি ক্যম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে ক্যাম্পাস সংলগ্ন শেখপাড়া বাজার ঘুরে একই স্থানে এসে ছাত্র সমাবেশে মিলিত হয়। শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ফয়সাল সিদ্দিকী আরাফাত ও সাধারণ সম্পাদক নাসিম আহমেদ জয়ের নেতৃত্বে এসময় উপস্থিত ছিলেন সংগঠনটির বিভিন্ন স্তরের প্রায় দুই শতাধিক নেতৃবৃন্দ। বিক্ষোভ মিছিলে ‘স্বাধীন এই বাংলায়, রাজাকারের ঠাঁই নাই, তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি, রাজাকারের চামড়া তুলে নিব আমরা, আমার সোনার বাংলায়, রাজাকারের ঠাঁই নাই ইত্যাদি সেøাগান দিতে দেখা যায়।
শাখা ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক নাসিম আহমেদ জয় বলেন, যারা রাজাকারের নাম উল্লেখ করে স্লোগান দেয় তারা স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি।  বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটিতে আর একবারের জন্য যদি এমন সেøাগান দেয় স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি ছাত্রলীগ তা সমূলে উৎপাটন করবে।
ছাত্রলীগের সভাপতি ফয়সাল সিদ্দিকী আরাফাত বলেন, যারা রাজাকারের নাম উল্লেখ করে সেøাগান দেয় আমরা তাদের ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করছি। রাজাকারের সাথে আমাদের কোনো আপোষ নেই। রাজাকার হয়ে এদেশে কেউ থাকতে পারবেন না। স্বাাধীনতা বিরোধী শক্তি সাধারণ শিক্ষার্থীদের আবেগকে পুঁজি করে দেশে অরাজকতার সৃষ্টি করছে। ছাত্রলীগ এই অপশক্তিকে প্রতিহত করবে।
তুমি কে, আমি কে? রাজাকার, রাজাকার সেøাগানে উত্তপ্ত জাবিজাবি সংবাদদাতা জানান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় দুইজন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীসহ তিনজন আহত হয়েছেন। এছাড়া হলের প্রভোস্ট প্রফেসর নাজমুল হাসান তালুকদার পদত্যাগ করেছেন। গত রোববার দিবাগত রাত তিনটার দিকে এ হামলার ঘটনা ঘটে। এর আগে, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যর প্রতিক্রিয়ায় রাত দশটার দিকে বিভিন্ন আবাসিক হলের শিক্ষার্থীরা, ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’, ‘চাইতে গেলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’ ইত্যাদি সেøাগান দিতে থাকেন।
এরপর রাত সাড়ে ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা এলাকায় জড়ো হন বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীরা। তখন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলে দুইজন আন্দোলনকারীকে অবরুদ্ধ করে ফোন তল্লাশির অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। এই খবর জানাজানি হলে রাত সাড়ে ১২টার দিকে বটতলা এলাকা থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে হলের সামনে গিয়ে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা।
এ সময় দুই শিক্ষার্থীকে আটকে রেখে মোবাইল তল্লাশির ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করতে প্রভোস্টকে হলের সিসিটিভি ফুটেজ দেখানোর অনুরোধ জানান আন্দোলনকারীরা। পরে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মীকে নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের প্রভোস্ট প্রফেসর নাজমুল হাসান তালুকদার। তখনো শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন হলের সামনে ও ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করছিলেন।
এরপর রাত দেড়টার দিকে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়কে বিক্ষোভ মিছিল করতে থাকেন আন্দোলনকারীরা। মিছিলটি রাত সোয়া দুইটার দিকে ফের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের সামনে গেলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বাধা দেন এবং মুখোমুখি অবস্থান নেন। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পরে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর প্রফেসর মোহাম্মদ আলমগীর কবিরসহ কয়েকজন শিক্ষক দুই পক্ষকে থামানোর চেষ্টা করেন। এ সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের জামায়াত-শিবির আখ্যা দেন ও নারী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে গালাগাল করেন।
এক পর্যায়ে রাত পৌনে তিনটার দিকে বাধা উপেক্ষা করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের পাল্টা ধাওয়া দেন শিক্ষার্থীরা। পরে আন্দোলনকারীরা হলের ফটকে গেলে তাদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। হামলার একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। এতে দেখা যায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল ছাত্রলীগের সভাপতি পদপ্রত্যাশী ৪৬তম ব্যাচের ছাত্র প্রাচুর্যসহ বেশ কয়েকজন হামলা করছেন।
এদিকে ছাত্রলীগের হামলায় আন্দোলনকারীদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী আহসান লাবিব এবং নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী সোহাগী সামিহা আহত হয়েছেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তাও আহত হয়েছেন। তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল সেন্টারে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের প্রভোস্ট নাজমুল হাসান তালুকদার ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উস্কে দিয়েছেন। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন প্রভোস্ট। পরে শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে হলের প্রভোস্ট পদ থেকে পদত্যাগ করার ঘোষণা দেন প্রফেসর নাজমুল হাসান তালুকদার। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের রাজাকার বলা হয়েছে। তারই প্রতিক্রিয়ায় আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি আহ্বান করি। এরমধ্যে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলে কয়েকজন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী স্লোগান দেওয়ায় তাদের আটকে রেখে মোবাইল তল্লাশি করা হয়েছে- এমন খবর পেয়ে হলের সামনে যাই। পরে হল প্রভোস্টের কাছে সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে চাইলে তিনি ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে ছাত্রলীগকে উস্কে দেন। এ সময় ছাত্রলীগ আক্রমনাত্মক স্লোগান দিয়ে আমাদের উপর হামলা চালালে আমরা পাল্টা ধাওয়া দিই।
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের অর্থ সম্পাদক ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল ছাত্রলীগের জ্যেষ্ঠ নেতা তৌহিদুল আলম তাকিদ বলেন, ‘আন্দোলনকারীরা আমাদের হলের সামনে এসে কোটা সংস্কারের নামে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও ছাত্রলীগকে অবমাননা করে স্লোগান দিচ্ছিল। তখন আমরা একটা শান্তিপূর্ণ মিছিল নিয়ে যেতে চাইলে তারা বাধা দেন এবং গালিগালাজ করেন। তাদের কোনো হামলা করিনি, যথেষ্ট সম্মান দেখিয়েছি। আমরা হলে ফিরে যাওয়ার সময় তারা আমাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়েছে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের প্রভোস্ট প্রফেসর নাজমুল হাসান তালুকদার বলেন, আজ যে ঘটনা ঘটেছে, সেটি অত্যন্ত দুঃখজনক। এভাবে হল চালানো সম্ভব না। আমি এই দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করছি।
রাতেই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) প্রফেসর মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ।  তিনি বলেন, ‘আমি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। এতো রাতে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব না। আজ সোমবার প্রশাসনের সকলে মিলে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
অন্যদিকে এই ঘটনা নিয়ে আজ সোমবার বেলা ১১টায় ভিসি প্রফেসর মো. নূরুল আলম, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) প্রফেসর মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ বিষয়টি নিয়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন বলে আশ্বাস দেন। এমন আশ্বাস পেয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ভোর সাড়ে চারটার দিকে নিজ নিজ হলে ফিরে যান।
ভিসি, প্রোভিসি সাথে আজ আলোচনা হয়েছে বলে নিশ্চিত করে এক আন্দোলনকারী জানান, আলোচনাকালে আমরা গতদিনের মতো প্রশাসনের কাছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের সিসিটিভি ফুটেজ দাবি করেছি। তবে আপাতত এটা দিতে অস্বীকার করেছেন তারা। এছাড়া আমাদেরকে অভিযোগ দায়ের করতে বলা হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে বলে জানান তারা। এই কমিটি হামলাকারীদের শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন ভিসি, প্রভিসি।  এছাড়া ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে গতকাল সন্ধ্যা সাতটায় মশাল মিছিলের ঘোষণা দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। ‘তুমি কে, আমি কে?, রাজাকার, রাজাকার’ স্লোগান দেওয়ায় অভিযোগে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আটকে রাখার প্রতিবাদে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। গত  রোববার রাত ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা এলাকা থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
পাবিপ্রবি শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠালেন ছাত্রলীগ নেতাপাবিপ্রবি সংবাদদাতা জানান,  পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (পাবিপ্রবি) এক শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করার অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতার বিরুদ্ধে। ওই ছাত্রলীগ নেতার নাম রাসেল হোসেন রিয়াদ। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক উপস্কুল ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক এবং জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর নাম গোলাম কিবরিয়া। তিনি সমাজকর্ম বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী। গতকাল সোমবার রাত তিনটার দিকে এই ঘটনা ঘটে। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী গোলাম কিবরিয়া জানিয়েছেন, রাসেল হোসেন রিয়াদ এবং তিনি অনেকদিন ধরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ৪০৭ নম্বর রুমে থাকেন। হলের রিডিং রুমে পড়াশোনার জন্য প্রতিদিন রাতে দুইটা-তিনটার দিকে তিনি রুমে আসেন। সোমবার রাত তিন টায় হলের রিডিং রুম থেকে পড়াশোনা করে রুমে আসেন। এরপর রুমের বাইরে গিয়ে ৫ মিনিট পরে রুমে এলে দেখেন রুমের দরজা বন্ধ। এরপর দরজা খোলার জন্য দরজায় নক করতে থাকলে এক পর্যায়ে রুমের দরজা খুলে রাসেল হোসেন রিয়াদ তার দিকে তেড়ে আসেন। তখন রুমের সামনে থাকা জুতা তুলে নিয়ে কিবরিয়াকে হাত এবং জুতা দিয়ে এলোপাতাড়ি মারতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে কিবরিয়ার নাক ফেটে রক্ত বের হলে তিনি দৌড়ে ৩০৪ নম্বর রুমে চলে যান।এ সময় রাসেল তার ফোন সেট ভেঙে ফেলেন। গোলাম কিবরিয়া বলেন, রাসেল প্রায় সময়ই রুমে ঝামেলা করতেন। রুমে রান্না করা নিয়ে, রুমে কথা বলা নিয়ে, লাইট জ্বালানো নিয়ে সমস্যা করতেন।

এমন আরো সংবাদ

Back to top button