ঋণের কিস্তি পরিশোধে শিথিলতা তুলে নেয়ার ব্যাপারে ঐকমত্য
গভর্নরের সঙ্গে ব্যাংক এমডিদের বৈঠক
ব্যাংকঋণের কিস্তি পরিশোধে ছাড় ছিল বিদায়ী বছরজুড়ে। সরকারের নির্দেশনা এবং ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এ সুযোগ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ২০২০ সালে কোনো কিস্তি পরিশোধ না করেই খেলাপি হওয়া থেকে বেঁচে গেছেন ঋণগ্রহীতারা। তবে ঋণ পরিশোধের সময়সীমা নতুন করে আর বাড়ানো হচ্ছে না। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে বৈঠকে সময়সীমা না বাড়ানোর পক্ষেই মত দিয়েছেন দেশের সব ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরা। একই অভিমত জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদও। সে হিসেবে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ঋণ শ্রেণীকরণের মেয়াদ গণনা শুরু হলো।
গতকালের বৈঠকে গভর্নর ফজলে কবির ঋণ পরিশোধে বাধ্যবাধকতার মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে ব্যাংক এমডিদের মতামত জানতে চান। তখন ব্যাংক এমডিরা বলেন, ‘উদ্যোক্তাদের কথা চিন্তা করে বছরব্যাপীই ঋণ পরিশোধে ছাড় দেয়া হয়েছে। এখন নতুন করে মেয়াদ বাড়ানো ঠিক হবে না। ব্যাংকের অর্থ ব্যাংকে ফেরার সময় এসেছে।’ ব্যাংক নির্বাহীদের এ দাবির সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও ঐকমত্য পোষণ করেছে বলে সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত করেছেন।
করোনাভাইরাস সৃষ্ট আর্থিক দুর্যোগ থেকে ঋণগ্রহীতাদের সুরক্ষা দিতে বিদায়ী বছরের এপ্রিলে ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতায় স্থগিতাদেশ দেয়া হয়। সরকারের নির্দেশনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত কোনো ঋণগ্রহীতা ঋণ শোধ না করলেও ঋণের শ্রেণীমানে কোনো পরিবর্তন আনা যাবে না। এরপর এ ছাড়ের মেয়াদ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। পরে তৃতীয় দফায় প্রজ্ঞাপন জারি করে এ সুযোগ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও ডিসেম্বর শেষ হওয়ার আগেই ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) পক্ষ থেকে ঋণ পরিশোধে শিথিলতার মেয়াদ জুন পর্যন্ত বাড়ানোর দাবি জানিয়ে গভর্নরকে চিঠি দেয়া হয়েছিল। ব্যাংক চেয়ারম্যানদের কেউ কেউ একই দাবি জানিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সময়সীমা না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
২৬ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্ষদ সভায় ঋণ শ্রেণীকরণের সময়সীমা বাড়ানোর প্রস্তাবটি উত্থাপন করা হয়েছিল। তখন পর্ষদ থেকে এ বিষয়ে নেতিবাচক মতামত দেয়া হয়। গতকাল ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরাও একই মতামত দেয়ায় ঋণ পরিশোধে শিথিলতার মেয়াদ না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম জানিয়েছেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীরা ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা না বাড়ানোর অনুরোধ করেছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক পর্ষদের অভিমতও প্রায় একই। এজন্য নতুন করে এ সময়সীমা বাড়ানো হবে না।
ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাধারণ সম্পাদক ও সিটি ব্যাংকের এমডি মাসরুর আরেফিন বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থে ঋণ পরিশোধে শিথিলতা দেয়া হয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তকে তখন আমরা সবাই স্বাগত জানিয়েছিলাম। কিন্তু এ ধরনের সুবিধা দীর্ঘমেয়াদে চলতে পারে না। এজন্য এবিবির পক্ষ থেকে আমরা ঋণ শ্রেণীকরণের মেয়াদ না বাড়ানোর অনুরোধ করেছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমাদের মতামতের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। মেয়াদ আবারো বাড়ানো হলে ব্যাংকগুলোর পক্ষে টিকে থাকা কঠিন হতো। এখন ব্যাংকের অর্থ ব্যাংকে ফেরার সময় হয়েছে।
ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে দেশের ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘ব্যাংকার্স সভা’ আয়োজন করা হয়। মহামারীর কারণে গতকালের বৈঠকটি হয়েছে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে। বেলা ৩টায় বাংলাদেশ ব্যাংকের এএন হামিদুল্লাহ সম্মেলন কক্ষ থেকে গভর্নর ফজলে কবিরসহ গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা বৈঠকে যোগ দেন। ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে ব্যাংক নির্বাহীরা অনুষ্ঠানে যুক্ত হন।
বৈঠকে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, মুদ্রানীতি, সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের অগ্রগতি, ঋণে ৯ শতাংশ সুদহার কার্যকর, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতের অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থতাসহ ব্যাংক খাতের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, মহামারী সৃষ্ট দুর্যোগ থেকে দেশের উদ্যোক্তাদের বাঁচাতে সরকারের পক্ষ থেকে ১ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। এসব প্যাকেজের সিংহভাগই বাস্তবায়ন হচ্ছে ব্যাংক খাতের মাধ্যমে। ব্যাংকগুলো এরই মধ্যে বৃহৎ শিল্পের জন্য ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করেছে। এজন্য ব্যাংকার্স সভা থেকে তাদের ধন্যবাদ জানানো হয়েছে। তবে বেশির ভাগ ব্যাংকই সিএসএমই ও কৃষি খাতের জন্য ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এজন্য ঘোষিত প্যাকেজ শতভাগ বাস্তবায়নের জন্য ব্যাংকগুলোকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত সময় দেয়া হয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সবক’টি প্রণোদনা প্যাকেজের শতভাগ বাস্তবায়ন কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেখতে চায়।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে বৈদেশিক অপরিশোধিত স্বীকৃত বিলের সংখ্যা বাড়ছে। এতে বিদেশীদের কাছে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর ভাবমূর্তি খারাপ হচ্ছে। পাশাপাশি খারাপ হচ্ছে দেশের ঋণমাণও। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলোকে অপরিশোধিত বৈদেশিক স্বীকৃত বিল দ্রুততার সঙ্গে পরিশোধের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে ব্যাংকগুলোকে অপরিশোধিত স্থানীয় স্বীকৃত বিলের অর্থও দ্রুত পরিশোধের নির্দেশ দেয়া হয় বলে গতকালের বৈঠক সূত্রে জানা গেছে।